জগতসমূহের বিবর্তনের প্রকৃত ধারণা (এবং সত্যস্বপ্ন)

Baitul Maqdis

আল্লাহর সৃষ্টিজগতের সবকিছু বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। আল্লাহর সৃষ্টির অন্য সবকিছুর মত সময়েরও বিবর্তন হয়েছে, এবং তার মধ্যে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

১…কুন

সৃষ্টির শুরু হয়েছিল একটি ‘কুন’ বা ‘হয়ে যা’ শব্দ দিয়ে, অতএব বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন সৃষ্টি বিভিন্ন পর্যায় ও বিভিন্ন জগতে আবির্ভূত হয়। সৃষ্টিগজতের সবকিছুর সাথে সময়েরও বিবর্তন হয়, এবং তার মধ্যে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়। এভাবে আল্লাহ স্থান ও সময়ের সাতটি ভিন্ন ভিন্ন জগত সৃষ্টি করেন। অন্য সমস্ত সৃষ্টবস্তু যার যার পরিচিত স্থান ও সময়ে স্থিত হয়।

সৃষ্টজগতের বিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয় এক কুদরতী আদেশ তথা ‘কুন’ শব্দের মাধ্যমে। বিজ্ঞানে এর হাইপোথেটিকাল নেম বিগ ব্যাং।

“তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেন তখন সেটিকে এ কথাই বলেন, ‘হয়ে যাও!’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।” (সূরা বাকারা, ১১৭)

২…বিবর্তন দুই জিনিসের – স্থান ও সময়ের

হাদীস থেকে জানা যায় ‘প্রথম সৃষ্ট আলোর’ কথা যাকে সকল সৃষ্টির উৎস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জাবির রাযিআল্লাহু তায়ালা য়ানহু থেকে বর্ণিত, “আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে জানিয়ে দিন আল্লাহ কোন জিনিসটি অন্য সবকিছুর আগে সৃষ্টি করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু য়ালাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, মহান আল্লাহ তায়ালা সবকিছু সৃষ্টি করার আগে নিজের নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” এটিই সৃষ্টির প্রথম পর্যায়।

সৃষ্টির প্রথম পর্যায়কে বলা যায় সূক্ষ্ম অস্তিত্বের পর্যায়, অর্থাৎ যা বস্তুর মত স্থূল নয়, বরং যা স্থানহীন ও সময়হীন। সৃষ্টির সেই সূক্ষ্ম অস্তিত্বের পর্যায়ে আল্লাহপাক মানুষ ও নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। (দ্রঃ সূরা আ’রাফ, ৭ঃ১৭২) ও (দ্রঃ সূরা আল ইমরান, ৩ঃ৮১)

অতঃপর স্থান ও সময়ের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় কোন এক আলোর জগতে ফেরেশতা সৃষ্টি হয়। এভাবে আগুনের জগতে জ্বীন জাতির সৃষ্টি হয় এবং মাটি, পানি ও আলো-হাওয়ার জগতে মানব, প্রানী ও উদ্ভিদকূলের সৃষ্টি হয়।

বিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় পূর্ববর্তী সৃষ্টির তুলনায় পরবর্তী সৃষ্টি সূক্ষ্মতা, পরিমার্জন, অস্পৃশ্যতা এবং গুণসম্পন্নতার দিক দিয়ে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। পক্ষান্তরে প্রগতির ধারায় পরবর্তী সৃষ্টির স্থূলতা, অনুভবযোগ্যতা, ভিন্নতা এবং পরিমাপযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এটাই হচ্ছে সৃষ্টজগতের মধ্যে এক জিনিস থেকে আর এক জিনিসের উৎপত্তি, বা ‘হয়ে যাওয়া।’ এই প্রক্রিয়া সদা সর্বদাই বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

কিন্তু তা কখনোই র‍্যান্ডমলি বা স্বাধীনভাবে হয় না। কারণ সৃষ্টিজগত শুধু আল্লাহ তায়ালার গুণবাচক নাম আল-খালিক্বের মুখাপেক্ষী নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার আর দু’টি গুণবাচক নাম আর-রব্ব ও আর-রাজ্জাকের মুখাপেক্ষী। আর-রব্বের অর্থ পালক, রক্ষক, পরিবর্ধক ইত্যাদি। আর-রাজ্জাক অর্থ রিযিকদাতা।

কোন জাতি ও বস্তুকে আল্লাহ কি পরিমাণ বিকশিত করবেন এবং তাকে কিভাবে সৃষ্টিজগতে প্রতিপালন করবেন তার মাত্রা নির্দিষ্ট করা আছে।

“আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা (পরিমাপ) ।” (সূরা তালাক্ব, ৬৫ঃ৩)

এর মধ্যে রয়েছে সময়েরও বিবর্তন ও মাত্রা যার বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন সৃষ্টি পূর্ণতা পেয়েছে। কুরআন সাতটি ভিন্ন আকাশের অস্তিস্ত্বের কথা বলেছে যা একে অন্যের পাশাপাশি অবস্থান করে, এবং এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে সময়েরও সাতটি মাত্রা রয়েছে, যার ভেতর দিয়ে দুই দিকেই গমনাগমন করা যায়, এবং এর প্রত্যেকটিই পৃথিবীর জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।

“তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন খুঁত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও, কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি?” (সূরা মূলক, ৬৭ঃ৩)

সময় ও স্থানের বিভিন্ন মাত্রার ভেতর দিয়ে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে। পরিশেষে সে এই পৃথিবীতে এসে হাজির হয়েছে। ইতিমধ্যে সময় ও স্থানের কোন এক মাত্রায় তাকে আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে আল্লাহর একত্ববাদের অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হয়েছিল। (দ্রঃ সূরা আ’রাফ, ৭ঃ১৭২)। আবার অচিরেই মানুষ মৃত্যূ, কবর, হাশর, পুলসিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদির মাধ্যমে সময় ও স্থানের অন্য মাত্রায় আরোহণ করবে।

“আমি শপথ করি সন্ধ্যাকালীন লাল আভার; এবং রাত্রির, আর তাতে যা কিছুর সমাবেশ ঘটে তার, যখন তা’ পূর্ণরূপ লাভ করে। নিশ্চয়ই তোমরা এক স্তর থেকে আরেক স্তরে আরোহণ করবে।” (সূরা ইনশিক্বাক্ব, ৮৪ঃ১৬-১৯)।

৩…সত্যস্বপ্ন

সত্যস্বপ্ন বা ধর্মীয় ভাববাণী (Prophecy) স্থান ও সময়ের বিভিন্ন মাত্রার বাস্তবতা ব্যাখ্যা করে। সত্যস্বপ্নের দৃশ্যগুলি এমন ঘটনা যা বিবর্তনের মাধ্যমে এখনো বিভিন্ন জগত পার হচ্ছে। সত্যস্বপ্ন অদৃশ্য জগতের বাস্তবতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সরবরাহ করে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু য়ালাইহিস সালাম বলেছেন, সত্যস্বপ্ন (এবং সেই সাথে আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি) নবুয়ত শেষ হবার পরেও থাকবে।

“যখন কেয়ামতের সময় নিকটবর্তী হবে, তখন মু’মিনদের স্বপ্ন খুব কমই ব্যর্থ হবে; বিশ্বাসীদের স্বপ্ন নবুয়তের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ।”

স্বপ্ন সত্যে পরিণত হবার কারণ এই যে, ঘটে যাবার আগেই সেগুলো অস্তিমান ছিল। আমরা আগেই জেনেছি, কোন ঘটনার সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয় আল্লাহর কুদরতি আদেশ ‘কুন’ থেকে। তারপর সেটা সময় ও স্থানের বিভিন স্তর পেরিয়ে বস্তুজগতে প্রকাশ পায় বা সংঘঠিত হয়। পৃথিবীতে ঘটে যাবার আগেই যখন সেটি আধ্যাত্মিক গোচরে আসে, তাকে সত্য স্বপ্ন বলা হয়।

কুরআনে স্বপ্নের কথা আছে, কিন্তু আমাদের সেক্যুলার শিক্ষা স্বপ্নকে অস্বীকার করে। আজকালকার অনেক হুজুর সেকুলার হয়ে গেছে। তারা এখন আর স্বপ্ন টপ্ন বিশ্বাস করে না, এর ব্যাখ্যাও দেয় না।

৪…সাত আকাশ

সময় ও স্থানের বিভিন্ন মাত্রাকে আকাশ বা সামাওয়াত বলা হয়। এটি পরিষ্কার যে, আমরা সেই মিলনস্থল নির্ধারণ করতে পারি না, যেখানে প্রথম আকাশ বা স্তর শেষ হয়েছে আর দ্বিতীয় আকাশ বা স্তর শুরু হয়েছে। কারণ আকাশগুলি এমন নয় যে তা লম্বভাবে একে অপরের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বরং প্রতিটি আকাশ নিজস্ব মাত্রা বজায় রেখে একটি অপরটির সাথে মিশে রয়েছে। এজন্যই মানুষ যখন সিজদায় যায় তার আর আল্লাহর মাঝে আর কোন দূরত্বগত বাঁধা থাকে না। অথবা মানুষ যখন শহীদ হয় মৃত্যুর পূর্বেই তার কাছে জান্নাতের জগত এনে হাজির করা হয়। সে দুনিয়ায় থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পায়।

কিভাবে আলাহ তায়ালা সাতটি আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন এ ব্যাখ্যার মধ্যে নিহিত আছে আল্লাহ যে সর্বত্র বিরাজমান এ বিতর্কের অবসান। আল্লাহপাক তার আরশে সমাসীন কিন্তু সেই আরশ হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে নয়। বরং আমাদের ঘাড়ের শাহ ধমনীর থেকেও নিকটে। কিন্তু তাঁর ও আমাদের মধ্যে আছে সাতটি আকাশের আপাত অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব।

ঠিক যেমন আমল নামা লেখার সম্মানিত ফেরশতা কিরামান কাতিবীন আমাদের দু’ঘাড়ে অবস্থান করেও কিন্তু আমাদের আকাশ বা সামা’তে নয় বরং স্থান ও সময়ের অন্য মাত্রায় অবস্থানরত।

অতএব এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে প্রবেশ করার জন্য মহাকাশ যানের সাহায্যে হাজার হাজার আলোকবর্ষ ভ্রমণ করার প্রয়োজন নেই। যে কোন মুহূর্তে এক মাত্রা থেকে বেরিয়ে অন্য মাত্রায় প্রবেশ করা যায়। একাজ করার জন্য কোন কর্মচাঞ্চল্যের প্রয়োজন নেই, অর্থাৎ সময় ও স্থানের ভেতর নড়াচড়ারও প্রয়োজন নেই।

এখানেই পাওয়া যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু য়ালাইহিস সালামের ইসরা ও মি’রাজের অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা, যখন তিনি মক্কা হতে জেরুজালেম পর্যন্ত এবং তারপরে সপ্তাকাশের ভিন্ন ভিন্ন সময় ও স্থানের মাত্রার ভেতর দিয়ে আরোহণ করে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে ঈসা য়ালাইহিস সালামের আসমানে আরোহণ, এবং দাজ্জালের এক দিন সমান এক বৎসর, এক দিন সমান এক মাস ও এক দিন সমান এক সপ্তাহ ভিন্ন স্থান ও সময়ের মাত্রায় কাটিয়ে আমাদের পরিচিত স্থান ও সময়ের মাত্রায় এক দিন সমান এক দিনে ফিরে আসা।

হতে পারে দাজ্জালের এক বৎসর পৃথিবীর প্রায় সাতশ বছরের সমান যা প্যাক্স ব্রিটেনিকা নামে পরিচিত। আবার তার এক মাস পৃথিবীর প্রায় ৭০-৮০ বৎসরের সমান যা প্যাক্স আমেরিকানা নামে পরিচিত। আমরা অপেক্ষায় আছি দশ বিশ বছরের প্যাক্স জুদাইকার যা হবে পৃথিবীর ভয়ঙ্কর যুদ্ধের ফিতনার দিন।

ইসলাম স্থান ও সময়ের বিবর্তনকে ঠিক ঠিক ব্যাখ্যা করে যার মধ্যে নিহিত আছে হেকমত বা প্রকৃত বিজ্ঞান। এটা বুঝার জন্য প্রয়োজন ঈমান। ডারউইনবাদ বা নাসার মহাকাশ বিজ্ঞান অথবা ইউরোপ আমেরিকার সেক্যুলার সায়েন্টিফিক জ্ঞান দ্বারা তার কিছুই বুঝা যাবে না।

আল্লাহু য়ালাম।

(শায়খ ইমরান নযর হোসেনের ‘সূরা কাহাফ এবং বর্তমান বিশ্ব’ এবং ‘পবিত্র কুরআনে জেরুজালেম’ গ্রন্থ অবলম্বনে)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান